সেদিনই ট্রেনে বসে ঠিক করেছিলাম, বাবা হলে ছেলের নাম রাখব "কণাদ"। ওহো আপনারা তো আবার চেনেন না তাঁকে, ঘরের ছেলে পাশে থাকতে হিরো খুঁজতে ছোটেন ইজরায়েল বা লাতিন আমেরিকায়। আজব জাত মাইরি এই বাঙালি! যাকগে যে কথা বলছিলাম....


পকেটে টাকা আসলেই আমার পায়ের তলার সর্ষেগুলো সুড়সুড়ি দিয়ে ওঠে। বছর ছয়েক আগের কথা। জম্মু থেকে সিমলা, কুলু, মানালির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। ঘণ্টাদুয়েকের ট্রেন জার্নি। জম্মু থেকে কালকা, ওখান থেকে টয়ট্রেন ধরব। আমরা চারবন্ধু মশগুল ছিলাম ইউ এস মেরিন সেনারা কতটা ডেডলি এইসব আলোচনায় হঠাৎ, 
- আপ লোগ বংলা সে হো পুত্তর? 
- হা, হুঁ (জবাবটা আমিই দিলাম) 
বক্তা আমাদের সামনের সিটের এক ভদ্রলোক, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হালকা ভু্ঁড়ি তবুও বেশ ফিট চেহারা।
- আপলোগ কলকাত্তা সে হো? 
বাইরে এই জিনিসটা অনেকবারই ফেস করেছি। বাঙালি মানেই কলকাতা কানেকশন। হয়তো এই শহরের নামটাই বেশি পরিচিত তাই। জানালাম আমি কলকাতায় থাকি, বাকিরা শহরতলীতে। 
কথা এগোল, ভদ্রলোকের সঙ্গে একথা-সেকথার পর আসলো খাবারের অফার। নিজের সঙ্গে থাকা টিফিন থেকে কি একটা সুস্বাদু খাবার অফার করলেন (নামটা মনে করতে পারছি না)। 


তারপরই বললেন এমন একটা কথা যেটা শুনলে যে কোন বঙ্গসন্তান গর্ব অনুভব করবে। 
 
- বঙালি লেড়কে বহুত হিম্মতওয়ালে হোতে হ্যায়। ব্রেভ গাইজ। 
- বলে কী সর্দারজী ? সারা জীবন ধরে শুনে আসছি বাঙালি ভীতুর ডিম, আর আজ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লড়াকু জাতের একজন বলছে কিনা "বঙালি লোগ বহুত সাহসী। ব্রেভ গাইজ"! আগ্রহ বেড়ে গেল। 
- কিঁউ স্যার? এরকম কেন বোলতা...?
- আপ কলকাতা সে হো তব তো কণাদ ভট্টাচায্যি (Kanad Bhattacharya) কো পহচানতে হোগে ? 


- কণাদ ভট্টাচার্য, কণাদ ভট্টাচার্য, কণাদ ভট্টাচার্য, কোথায় যেন দেখেছি, কোথায় যেন শুনেছি...
অখুশি হলেন ভদ্রলোক। ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা পুরনো ছবি। দুজন সৈনিকের। ছবিতে ডানদিকে থাকা একটি ইয়ং সৈনিকের ছবি দেখিয়ে বললেন, 
-ইয়ে হ্যায় কণাদ। অউর ইয়ে ম্যায় হুঁ। ক্যয়া বন্দা থা। শালা জিন্দেগী মে বহুত ইনসান সে মিলে, লেকিন কণাদ, কুছ অলগ হি থা। 
আপলোগ ক্যয়া করতে হো পুত্তর? 
- জানালাম আপাতত চাকরির পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছি। 
- আর্মি জয়েন করো পুত্তর, কণাদ জ্যায়সা বনো। 

অবাক হয়ে গেলাম বুঝলেন। বাংলা থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে এক পাঞ্জাবি ব্যাগে করে এক বাঙালি ছেলের ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুকের ভিতরে অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ শুরু হল। 


একটা ছেলে বরানগরে জন্মে জয়পুরিয়া কলেজ থেকে পাশ করে দেরাদুন কিংবা বেলগাঁও কিংবা আরও কোথাও ট্রেনিং নিয়ে, শিখ রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধে নামে। কার্গিলের টাইগার হিলে বীরগতি প্রাপ্ত হয়। বাঙালিয়ানা শিখতে হলে এই ছেলেটার থেকে শিখুন।
 

কবে যেন চোখে পড়ল কে একজন ফেসবুকে একটি কমেন্টে লিখেছে "ভারত মাতা কি জয়" বলা যাবে না, ওটা বাংলা নয়! অথচ দেখুন বরানগরের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বড় হওয়া ছেলেটি "ভারত মাতা কি জয়" বলতে বলতে দেশের জন্য শহীদ হয়ে গেল। ইনি কি বাঙালি নন....?

"টাইগার হিল" শব্দটা শুনলেই আপনার আমার মনে " সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য"এর কথা মনে পড়ে। অনেকেই হয়ত জানেন না ভারতের দিক থেকে সোজা খাড়াভাবে উঠে গেছে কাশ্মীরের এই টাইগার হিল। চড়া খুব কষ্টের। বলতে পারেন কার্গিল যুদ্ধের (Kargil war) সবচেয়ে কঠিন পয়েন্ট। সামনে খাড়া পাহাড়। পাহাড়ের ওপর তখন শান্তির দূতেরা ডেরা বেঁধে রয়েছে। কিন্তু কণাদ তো কণাদই। কোন কিছুই থামাতে পারেনি তাঁকে।

শিখ রেজিমেন্টের টাইগারহিল অভিযানের সময় ২১শে মে ১৯৯৯ তে শহীদ হন কণাদ। মাস দেড়েক পর বরফের মধ্যে থেকে তার মৃত শরীর উদ্ধার করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। মরণোত্তর সেনাপদকে সম্মানিত করা হয় এই বাঙালী সন্তানকে। কার্গিল যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন পয়েন্ট "টাইগারহিলে" নিজের বীরগাথা লিখে রেখে গেছেন কণাদ। পরের বার কার্গিল বেড়াতে গেলে নিজের ছোট্ট শিশুটিকে জানিয়ে দিন কণাদ ভট্টাচার্যের নাম। বলুন দূরে ওই পাহাড়গুলোর গায়ে লেগে আছে এক বাঙালি ছেলের বীরত্বের কাহিনী । ‌Old soldiers never die, they only fade away...
              সৌজন্যে ✍🏻 শেখর ভারতীয়।
                  সম্পাদনা: স্বপন সেন

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন