দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারপোলের খাতায় " মোস্ট ওয়ান্টেড" এই ডনকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেও অপরাধ জগতের বেতাজ বাদশা এদেশের বুকে চালিয়ে গেছে তার সাম্রাজ্য। এবার কি তবে ধরা পড়লো করোনা'র হাতে ?
মুম্বাই পুলিশের হেড কনস্টেবল ইব্রাহিম কসকরের ঘরে ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় পুত্রটি যখন জন্মায় তখন ধর্মভীরু মানুষ টি নাম রেখেছিলেন দাউদ (Dawood Ibrahim)। সেদিন তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি ইসলামের এক নবীর নামে নাম রাখা এই সন্তান একদিন অপরাধ জগতের অধিপতি হবে, নাম থাকবে পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর তালিকায়!
সাত ভাই আর পাঁচ বোনের সংসারে ছোটবেলা থেকে অভাব দেখে আব্বুর ওপরে চরম বিরক্ত দাউদ। অবস্থা চরমে উঠলো যখন পুলিশ থেকে সাসপেন্ড হয়ে যান ইব্রাহিম। মুম্বাইয়ের লাস্যময়ী নায়িকা সুরাইয়ার বাবা হঠাৎ করে মারা গেলেন। মেয়ে চায়না বাবার পোস্টমর্টেম হোক। পুলিশ কে ম্যানেজ করলেন স্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট দিতে। ঘটনা টা কানে গেল রাজ্যের এক বিধায়কের। এমন হৈচৈ করলেন বিধানসভায়, যে চার পুলিশ কর্মীর চাকরি গেল। তাদের একজন হল ইব্রাহিম।
আসল ঘটনা হলো ঐ বিধায়ক বাবাজীর প্রেম নিবেদন কে পাত্তা দিতেন না সুরাইয়া। তিনি তো আর যে সে লোক ছিলেন না..... প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোবরজী দেশাইয়ের সুপুত্র কান্তিভাই দেশাই। বদলা নিয়ে দেখালেন তার ক্ষমতা।
ছোটখাটো ছিনতাই দিয়ে অপরাধ জগতে পা রাখা দুইভাই সাবির আর দাউদ নজরে পড়ে হাজী মাস্তানের। ঠান্ডা মাথা আর বেপরোয়া সাহসী দুই ভাই একসময়ে নিজেরাই গ্যাং তৈরি করে । তখনই গন্ডগোল শুরু হয় করিম লালার পাঠান গ্যাংয়ের সাথে। এতদিন মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতের লোকজন একে অন্যের এলাকায় মাথা গলাতো না। দাউদ কোম্পানি ভেঙে দিলো অলিখিত সেই নিয়ম। এর মাঝে চিত্রা নামে এক বার সিঙ্গারের প্রেমে পড়ে বড়ভাই সাবির। সেই মেয়েটিকে আবার পছন্দ করতো পাঠান গ্যাংয়ের আমিরজাদা। এক রাতে এক পেট্রল পাম্পের মধ্যে গুলি ও ছোরার আঘাতে খুন হয়ে যায় সাবির। মুম্বাইয়ের রাজপথ এই ঘটনার পর থেকে সাক্ষী হলো প্রকাশ্য গ্যাং ওয়ারের। সময়টা আশির দশকের গোড়ায়।
গ্রেফতার হয় আমিরজাদা কিন্তু ভাই এর হত্যার বদলা নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে দাউদ। যে কোন মূল্যে আমিরজাদাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কন্ট্রাক্ট কিলার ও স্মাগলার রাজন মহাদেবন নায়ার বা বড়া রাজনের সাথে যোগাযোগ করে সে। ডেভিড নামে এক শার্প স্যুটার মামলা ওঠার দিন আদালত চত্বরে খুন করে আমিরজাদাকে। ধরা পড়ে যায় ডেভিড আর সেই সুত্রে বড়া রাজন ও দাউদ ইব্রাহিমও গ্রেফতার হয়। হাজী মাস্তান (Haji Mastan) এর প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে জামিন পায় দাউদ।
আমিরজাদা হত্যার ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাঠানরা। দাউদ কে পাওয়া সহজ ছিল না কিন্তু রাজন তখনো হাজতে। আমিরজাদাকে আদালত প্রাঙ্গনে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেভাবেই আদালতে হাজিরার দিন বড়া রাজনকে হত্যা করার প্লান করা হয়। আবদুল কুঞ্জু নামে এক পাঠান পুলিশের ছদ্মবেশে এসে গুলি করে মারে রাজনকে।
বড়া রাজন খুন হওয়ার পর গ্যাং লিডার হয় রাজেন্দ্র সদাশিব নিকালজি ওরফে ছোটা রাজন। নেতা হয়েই আব্দুল কুঞ্জুকে হত্যা করে গুরু হত্যার বদলা নেয় সে। এরপর দাউদের সাথে সমঝোতায় এসে খুন করে বেশ কয়েকজন পাঠানকে, মুম্বাই থেকে সমূলে উচ্ছেদ হয়ে যায় গোটা গ্যাং! গুরু হাজী মাস্তান রাজনীতিতে যোগ দিলে দলের দায়িত্ব পুরোপুরি চলে আসে দাউদের হাতে। মুম্বাই এর আন্ডারওয়ার্ল্ড(underworld) জগতে প্রতিষ্ঠা হয় ডি-কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য।
একের পর এক হত্যা ও ডি-কোম্পানির (D-Compay) নানা অপরাধকর্মে মুম্বাই পুলিশ কঠোর হতে বাধ্য হয়। শুরু হয় ধরপাকড়, এনকাউন্টার। মারা যায় বহু অপরাধী। জান বাঁচাতে দাউদ পালিয়ে যায় মাফিয়াদের নিরাপদ স্বর্গরাজ্য দুবাইতে। ছোট রাজন এর মাধ্যমে দুবাইতে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতো সবকিছু। গ্রেফতার এড়াতে ১৯৮৯ সালে ছোটা রাজনও পাড়ি দেয় দুবাইতে। উঠে আসে ছোটা শাকিল, সেই হয়ে ওঠে দাউদের ডান হাত।
১৯৯১ সালে দাউদের প্রতিদ্বন্দী অরুন গাউলির গ্যাং (Arun gawli gang) এর হাতে খুন হয় দাউদের বোন হাসিনা পারকারের স্বামী। স্বামীর খুনের পর হাসিনা (Haseena Parkar) পারকার নিজেই প্রবেশ করে অপরাধ জগতে! সে ও ছোট শাকিল (Chhota Shakeel) মিলে পরিচালনা করতে থাকে ডি-কোম্পানির সাম্রাজ্য ও ব্যবসা। দাউদ ভারতের বাইরেও বিস্তৃত করতে থাকে তার ব্যবসা। দুবাই, পাকিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে। এমনকি বলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও (bollywood film industry) বাড়তে থাকে তার বিনিয়োগ।
আরও পড়ুন:ছবি বিশ্বাসের মত একজন বিখ্যাত অভিনেতা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, ঘটনাটি আমার মায়ের কাছে শুনেছিলাম !
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর মুম্বাইতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। আসরে নামে পাকিস্তান। ISI যোগাযোগ করে দাউদের সাথে। ডি কোম্পানির সহায়তায় ১৯৯৩ সালে মুম্বাই শহরে সিরিজ বোমা হামলায় আড়াইশো মানুষ নিহত ও সাতশো জন আহত হয়। বিনিময়ে করাচিতে দাউদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করে পাকিস্তান।
এদিকে মুম্বাই হামলার পর ছোট রাজনের সাথে দাউদ ইব্রাহিমের (Daud Ibrahim) ঝগড়া শুরু হয়, কিছুটা কৃতিত্ব অজিত দোভালের। পরিনামে পৃথক হয়ে যায় দুই গ্যাং। আবারও শুরু হয় রাজপথে প্রকাশ্য গ্যাং ওয়ার। ছোটা রাজন পালিয়ে যায় দেশ ছেড়ে।
২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে।
২০০৬ সালে দাউদের মেয়ে মাহরুখ ইব্রাহিমের (Mahrukh Ibrahim) সাথে বিয়ে হয় পাকিস্তানের ক্রিকেটার জাভেদ মিঁয়াদাদের ছেলে জুনায়েদ এর। মেয়ের বিয়েতে অবশ্যই হাজির হবে দাউদ ফলে অনুষ্ঠানে র, ইন্টারপোল, এফবিআই সবার ছিল তীক্ষ্ণ নজরদারী। দুবাই এ অনুষ্ঠান স্থল ও আশেপাশে ছিল এইসব গোয়েন্দা সংস্থার অসংখ্য এজেন্ট। আইএসআই থেকে দাউদ কে নিষেধও করা হয়েছিল যেন বিয়ের অনুষ্ঠানে না যায়। কিন্ত দাউদ ঠিকই এসেছিল, মেয়ে জামাই এর সাথে দেখাও করেছে অথচ উপস্থিত এজেন্টরা কেউ বুঝতে পারেনি।
কলম্বিয়ার ড্রাগ মাফিয়া পাবলো এস্কোবার এর পর দাউদ হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী মাফিয়া ডন (The second richest mafia don)। সাত বিলিয়ন টাকার মালিক দাউদের অর্থের সাথে লেগে আছে কত মানুষের রক্তের দাগ, কত মাদকের দুর্গন্ধ! অথচ কোন দেশের পুলিশ আজ পর্যন্ত তাকে জেলে ঢোকাতে পারে নি, কখনো পারবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র: Dongri to Dubai.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন