তখন পাঁচের দশকের শেষদিকে।
আমার বাবা, ডাক্তার জ্যাঠামশাই ও আমাদের এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বনমালী দাস এই তিন জন মিলে একটি সিনেমা প্রযোজনা করেন।সিনেমাটির নাম "অগ্নিসম্ভবা"(Agisambhabha)ক্যানসারের ঔষধ আবিষ্কার নিয়ে গল্প। ছবি বিশ্বাস ছিলেন মুখ্য চরিত্রে। আর ছিলেন নির্মলকুমার,কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী প্রমুখ।
আমার বাবা ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। বর্ধমানের রায়না হাইস্কুল থেকে সেই আমলে ম্যাট্রিকুলেশনে চারটি বিষয়ে তিনি লেটার নিয়ে পাস করেন। বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ করলাম এজন্য যে এই কারণে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর হয়েছিল।সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বনমালী দাস (Banamali Das) মহাশয়ের আত্মীয় কালোবরণ দাস ছিলেন সেইসময় বেশ কিছু বাংলা সিনেমার মিউজিক ডিরেকটর।মূলত কালোবরণ দাসের বারবার অনুরোধে "অগ্নিসম্ভবা" ফিল্ম প্রযোজনা করতে সবাই অনিচ্ছা সত্বেও রাজী হন।
কাস্টিং ফাইনাল হওয়ার পর বাবার সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের (Chhabi Biswas) পরিচয় হয়।বাবা বয়েসে বড় ছবি বিশ্বাসকে দাদা বলে সম্বোধন করতেন।ছবি বিশ্বাস ছিলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র। তিনি বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টা শুনে খুব খুশী হয়েছিলেন। মূলত এই কারণেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে বাবা ছবি বিশ্বাসের একজন প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
একবার ছবি বিশ্বাসের শুটিং পড়েছিল বর্ধমানে সদরঘাটের কাছে পাল্লা রোডে।তিনি বাবাকে কথা দিয়েছিলেন বর্ধমান থেকে শুটিং করে ফেরার সময় আমাদের বাড়িতে আসবেন।
ছবি বিশ্বাস এলেন রাত আটটা নাগাদ তাঁর মোটরে করে। ছবি বিশ্বাস একটা দামী লেদারের ব্যাগ হাতে নামলেন। শুটিং করে ফিরছেন। ক্লান্ত শরীর।প্রথমে এক কাপ চা খেলেন। তারপর একটু গল্পগুজব করলেন।খুবই সাধারণ সব কথাবার্তা।
মায়ের কাছে শুনেছি ছবি বিশ্বাস খুব লম্বা চওড়া মানুষ ছিলেন।
ধপধপে ফর্সা। রাজার মত চেহারা।ছবির মতই যেন সুন্দর। সেইসময় আমাদের বাড়িতে কোন ডাইনিং টেবিল ছিল না। ছবি বিশ্বাস আনন্দের সঙ্গে মেঝেয় আসনের ওপর বসে কাঁসার থালায় খেয়েছিলেন মায়ের হাতে তৈরী চারটি লুচি, আলুর দম ও আরো কিছু এবং একটি রাজভোগ।খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন। বারবার বলা সত্বেও চারটের বেশি লুচি খাননি।
সেই কাঁসার থালা বাটি গ্লাস এখনও আমাদের বাড়িতে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাখা আছে।ঐ থালা আর কোনদিন ব্যবহার করা হয়নি।
ছবি বিশ্বাস ফিরে যাচ্ছেন।মা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।
উনি বড় দাদার মত মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন,
সুখী হও।
এবার ব্যাগের ভেতর একটি শাড়ির প্যাকেট বার করে মায়ের হাতে তুলে দিলেন আর এক প্যাকেট বর্ধমানের সীতাভোগ।
রাজার মত মোটরে বসলেন। হাত নাড়লেন।গাড়ি ছুটল কলকাতার দিকে।একজন বিখ্যাত মানুষ আমাদের মত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসে কত ভালবাসা আর স্নেহের স্পর্শ রেখে গেলেন!
আজ ছবি বিশ্বাসের প্রয়াণ দিবসে (১৯০০- ১৯৬২) এইভাবে শ্রদ্ধা জানালাম।
পুনশ্চঃ
সেইসময় অগ্নিসম্ভবা সিনেমাটি আর্ট এ্যান্ড কালচার প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে নির্মিত হয়েছিল।
১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসের একটা পকেট ডায়েরি আমাদের বাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে।
সেখান থেকে শুধু একটি পাতার ফটো এখানে দেওয়া হল, সিনেমা নির্মাণ সংক্রান্ত কিছু টাকাপয়সা তোলা ও খরচের হিসেব।
এটা দিলাম সিনেমাটি নির্মাণের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন