১০ই জুন ১৯৭৩ । স্টেট ব্যাঙ্কের কোন এক শাখা থেকে নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের তিনটে ট্রাঙ্ক ভর্তি ভারতীয় টাকা এসে পৌঁছালো বিরাটনগর এয়ারপোর্টে । অপেক্ষারত একটা Twin Otter বিমানে ওঠানোর পর উনিশ জন যাত্রী ও তিনজন ক্রু মেম্বার নিয়ে Royal Nepal Airlines এর বিমানটি উড়লো কাঠমান্ডুর দিকে । ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে আটটা ।
পাঁচ মিনিট পরই তিন যাত্রী রিভলবার আর গ্রেনেড দেখিয়ে পাইলটকে বাধ্য করলো বিহারের ফরবেশগঞ্জে একটা মাঠে প্লেনটা নামাতে । আগে থাকতেই সেখানে অপেক্ষা করছিল তিনটে জীপ । তিনটে টাকার বাক্স আলাদা আলাদা জীপে তুলে নেবার পর বিমানটি ফের রওয়ানা হলো কাঠমান্ডু অভিমুখে । বিমানের ফাস্ট ক্লাসে সেদিনের একক যাত্রী ছিলেন বলিউড অভিনেত্রী মালা সিনহা ।
বিশ্বে বহু কারণে বিমান ছিনতাই হয়েছে কিন্ত দেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য ছিনতাইয়ের ঘটনা বড় একটা শোনা যায়না । রাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই ছিনতাইয়ের নেপথ্যে ছিলেন দিল্লিতে নির্বাসিত নেপাল কংগ্রেসের সভাপতি বিপি কৈরালা আর পুরো অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন সুশীল কৈরালা (Sushil Koirala) যিনি সেদিন ফরবেশগঞ্জে জীপে বসে রেডিও টেলিফোনের মাধ্যমে সমন্বয় রক্ষা করছিলেন ।
CBI এর তদন্তে একজন ছাড়া অংশগ্রহণকারী ছজনই ধরা পড়েন এবং তিহার জেলে তিনবছর কারাবাস ভোগ করেন ।
নেপাল কংগ্রেসের সম্পাদক এই সুশীল কৈরালার দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সেদেশে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং গণতান্ত্রিক ভোটে ১৯৫৯ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন বিপি কৈরালা । রাজা মহেন্দ্র এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত এই সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং সুশীল সহ নেপাল কংগ্রেসের প্রায় সবাই ষোল বছর ভারতে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হন ।
উচ্চ বংশোদ্ভূত সুশীল অবিবাহিত থেকে সারাজীবন নিজের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালান । বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে 2014 সালের ফেব্রয়ারী মাসে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হন । তাঁর আমলেই নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় এবং উদ্ধার কাজ তদারকির জন্য বহুদিন তিনি তাঁবুতে রাত কাটিয়েছেন । মন্ত্রী থাকাকালীন সমস্ত ভাতা তিনি দুর্গতদের দান করতেন এমনকি একবার রেঙ্গুনে এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র ব্যাংক থেকে পাওয়া পাঁচশো ডলারও খরচ হয়নি বলে ফেরত দিয়েছিলেন । প্রধানমন্ত্রী আবাসে যাবার আগে অব্দি পার্টির ভাড়া বাড়িতে থাকতেন । জমিজমা তো বহুদূর নিজস্ব একটা বাড়িও ছিলোনা তার । নিজস্ব সম্পত্তি বলতে ছিল একটা আইফোন সহ আর দুটো সাধারণ ফোন । BBC এক সমীক্ষার পর তাঁকে #বিশ্বের_দরিদ্রতম_রাষ্ট্রপ্রধান আখ্যা দিয়েছিল
শখ বলতে ছিল একটাই ....ধূমপান, রাবণের চিতার মতো সর্বক্ষণ মুখে সিগারেট জ্বলতো । সেজন্যই ফুসফুস সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে কাঠমান্ডুর এক সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হন, সরকারের হাজার অনুরোধেও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে রাজী হননি । দশই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তে পঁচাত্তর বছর বয়সে এনার মহাপ্রয়াণ ঘটে ।
আজকাল যখন প্রধানমন্ত্রী তো দূর পাড়ার পুর কাউন্সিলরদের সম্পত্তির বহর দেখি তখন মনেহয় সুশীল কৈরালার মতো রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিন গ্রহের মানুষ, ভুল করে কিভাবে পৃথিবীতে চলে এসেছেন ! কলমে -স্বপন সেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন