সাপুরজীদের তৈরি 'সুখবৃষ্টি' আবাসনের বাসিন্দাদের সুখ-শান্তি দুদিন থেকে গায়েব। ঘনঘন গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল মহার্ঘ আবাসন চত্বর। দিনের শেষে সেখান থেকে উদ্ধার হলো কুখ্যাত দুই অপরাধীর লাশ, যাদের মাথার দাম দশলাখ টাকা! হন্যে হয়ে এতোদিন যাদের খুঁজছিল পাঞ্জাব ও আরো তিন রাজ্যের পুলিশ। আবারও প্রমাণ হয়ে গেল কলকাতা সহ গোটা বাংলা আজও ভিন রাজ্যের অপরাধীদের অভয়ারণ্য!
আশির দশকে খালিস্থানী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে বরখাস্ত এক পদস্থ পুলিশ অফিসার (নামটা মনে পড়ছে না) দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিলেন কলকাতায়। শুধু তাই নয়, এরাজ্যের শিখদের দেশবিরোধী কাজকর্ম করার জন্য নিয়মিত উস্কানিও দিয়ে গেছেন। পাঞ্জাব পুলিশের শত অনুরোধেও গা করেনি এখানকার প্রশাসন। ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরেরবার তারা আর অনুরোধ উপরোধের চক্করে যায়নি.....!
১৭ই মে, ১৯৯৩। রাত তখন একটা। তীব্র গরমের জন্য তিলজলার অনেক বাসিন্দাই সেদিন বিছানায় না গিয়ে ছাদে কিংবা বারান্দায় শুয়ে বসেছিল। হঠাৎই দুটো স্টেশন ওয়াগন ঢুকলো পাড়ায়। কৌতুহলী বাসিন্দাদের চোখের সামনে গাড়ি দুটি থেকে নেমে এলো জনাদশেক বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ, যাদের দু তিনজনের মাথায় পাগড়ি। হাতে ধরা স্টেনগান ও রিভলবার নিয়ে তাদের নিঃশব্দ পদচারণা ও চালচলন বুঝিয়ে দিয়েছিল এরা কোন মামুলি অপরাধী গ্যাংয়ের লোক নয়। ইঙ্গিতে পড়শীদের ঘরে ঢুকতে বলে এগিয়ে গেল একটি বিশেষ বাড়ির দিকে....!
বড় রাস্তা থেকে বেরিয়ে গলির শেষ প্রান্তের বাড়িটিতে গত তিনমাস ধরে ভাড়া থাকতো এক পাঞ্জাবী দম্পতি, বশির আহমেদ ও রানী। বাকিরা যখন বাড়ি ঘিরে ফেলতে ব্যস্ত, দুজন তখন পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে পডে। খাটিয়ায় শুয়ে থাকা দম্পতির ওপরে জানালা গলিয়ে খালি করে দেয় রিভলভারের গোটা চেম্বার। রক্তে মাখামাখি দুজনের লাশ ঘাড়ে করে নিয়ে এরপর উঠলো তারা বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে। হতভম্ব বাসিন্দাদের চোখের সামনে দিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো দুটো গাড়ি। পুরো অপারেশনটি শেষ হতে লেগেছিল মাত্র মিনিট পনেরো। ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পরে জানা যায় কুশীলবরা পাঞ্জাব পুলিশের covert "counter-terrorist"(Special Strike Force বা #SSF) বাহিনীর সদস্য। কিন্তু কাদের জন্য এই নৈশ অভিযান......?
নিহত বশীর আহমেদ ও রানী ছিলো নিষিদ্ধ 'বব্বর খালসা' দলের সদস্য যারা স্বাধীন খালিস্থান রাজ্য গঠনের জন্য দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছিল। তিরিশটির ওপর নরহত্যা ও ডাকাতির জন্য পাঞ্জাব পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম ছিলো এই দম্পতির। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিব পাঞ্জাব পুলিশের প্রশাসনিক সীমানা অতিক্রম করে এই অতি সক্রিয়তার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অভিযোগ জানান। কোন সদুত্তর না আসাতে সুপ্রীম কোর্টে এক আইনজীবী জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। কোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার CBI কে দেয়া হয়। পুরো একবছর পর তদন্তে উঠে আসে পাঁচ পুলিশ অফিসারের নাম। অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্র, খুন ও তথ্য লোপাটের অভিযোগে আদালত পাঞ্জাবের হোম সেক্রেটারিকে তাদের সাসপেন্ড করে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচার বহির্ভূত এই হত্যার তীব্র নিন্দা করে শীর্ষ আদালত নিহতদের পরিবার কে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও বলেন।
২১শে জুন ১৯৯৪, উলুবেড়িয়া।
সাতসকালে গুলির আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো বোম্বে রোডের ওপর এন্ট্রি ট্যাক্স দপ্তরের কর্মীরা। সম্বিত ফিরতে সবাই কিয়স্ক থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে দেখে রাস্তার ধারে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে এক সর্দারজি আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আরো আট নজন সশস্ত্র লোকজন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় পুলিশের হাইওয়ে পেট্রল ভ্যান।
তদন্তে উঠে আসে আবারও পাঞ্জাব যোগ। নিহত সর্দারের নাম কার্নেল সিংহ, বাড়ি রোপাড় জেলার ছোটা সামানা গ্রাম। ঐ জেলার নিষিদ্ধ সংগঠন Bhindranwale Tiger Force এর একজন কম্যান্ডার। সশস্ত্র এই জঙ্গী গোষ্ঠীর দাবি স্বাধীন খালিস্থান। বহু খুনজখম ও ডাকাতিতে জড়িত কার্নেল পুলিশের তাড়া খেয়ে গা ঢাকা দেয় এ রাজ্যে। হাইওয়ের ধারে কুলঝুড়ি গ্রামের এক মোটর গ্যারেজে মেকানিক সেজে থাকে। পাঞ্জাব পুলিশের কাছে খবর ছিল সেদিন তার কোন একটি ট্রাক ধরে মুম্বাই পালানোর পরিকল্পনা ছিল, আর তার আগেই সেখানে পৌঁছে যায় SSF বাহিনীর সদস্যরা। তারা অবশ্য স্বীকার করে নেয় কার্নেল সিংহ কে তারাই গুলি করেছে, শুধু আগেভাগে খবর দেয়নি এই যা !
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে পাঞ্জাব পুলিশের ঐ নজন সদস্য কে হেফাজতে নেয় রাজ্য পুলিশ। তিনদিন পর পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বিয়ন্ত সিংহের অনুরোধে তারা ছাড়া পায়। ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে উনি বলেছিলেন ভবিষ্যতে রাজ্য প্রশাসনকে না জানিয়ে এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।এসব কভার্ট অপারেশনে আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেতে যে সময় নষ্ট হয়, তাতে অপরাধীদের পালিয়ে যাবার পুরো সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে গতকাল যে তারা কথার খেলাপ করেনি, রাজ্য পুলিশের উপস্থিতিতেই তা প্রমাণিত।
দুর্জনরা অবশ্য বলে থাকেন পাঞ্জাব পুলিশের এই #SSF বাহিনীর লোকজন যতো ভালো ক্রাক শ্যুটার, ততোটাই খারাপ তাদের আইন জ্ঞান। তাই অপরাধীদের ধরে আদালত অব্দি নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তারা আর নিতে চায়না। সে যাইহোক, ঘটনাক্রম কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে পাঞ্জাব পুলিশের সোর্স নেটওয়ার্ক এখনও অব্দি দেশের মধ্যে সেরা !
কলমে ✍🏻 স্বপন সেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন