২৪ ডিসেম্বর, ১৯১২। দেরাদুন স্টেশন সংলগ্ন এক ছোট মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছে এক বছর তিরিশের যুবক। বিষয় - আগেরদিন অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর উপর প্রাণঘাতি বোমা হামলার নিন্দা করা। যুবকের তীব্র ভারত বিরোধী একের পর এক মন্তব্যে সভায় উপস্থিত বাঘা বাঘা ব্রিটিশ ও ভারতীয় পুলিশ অফিসাররা হাততালি দিচ্ছে। যুবকটির গোপন পরিচয় সভায় উপস্থিত দু-এক জন পুলিশ অফিসার জানে - সে একজন ব্রিটিশ চর, নাম রাসবিহারী বসু, বাড়ি বাংলার চন্দননগরে, চন্দননগরের বিপ্লবীদের বিভিন্ন খবরাখবর সে ইতিমধ্যে এনে দিয়েছে আর অরবিন্দ ঘোষ সম্বন্ধে বিচিত্র সব তথ্য সরবরাহ করেছে। এখন দেরাদুনে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা, কারণ দুদিন পরেই লর্ড হার্ডিঞ্জ বড়দিনের ছুটি কাটাতে এখানে আসছে। এই সভাতেই সেই যুবকের সাথে পরিচয় হয় বাংলার এক বিরাট বুদ্ধিমান ডিএসপি, সিআইডি সুনীলচন্দ্র ঘোষের, যে চূচেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে এ.কে.রে ওরফে সতীশচন্দ্র ওরফে মানিকলাল নামে এক ভয়ঙ্কর বিপ্লবীর পিছু ধাওয়া করছে। সেই ভয়ঙ্কর বিপ্লবীর বড় আইডেন্টিটি হল তার বাম হাতের মাঝের আঙুলটা প্রায় নেই। এদিকে দুদিন পরে লর্ড হার্ডিঞ্জ দেরাদুনে আসে। সে সময় লর্ডের উদ্দেশ্যে কিছু লোকজন সমেত মাটিতে শুয়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে প্রণাম জানিয়েছিল এই যুবকটি।
এবার আমরা বহু বছর পরে এই যুবকটির বিরুদ্ধে ওঠা মামলায় বিরাট বুদ্ধিমান সিআইডি ডিএসপি সুনীল ঘোষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জবানবন্দিতে চলে যাবো .. ততোদিনে সুনীল ঘোষ যুবকটিকে নাম দিয়েছে 'ঘড়িয়াল' ..
মি লর্ড..
ঘড়িয়ালটার সাথে আমার প্রথম আলাপ দেরাদুনের এক প্রতিবাদ সভায়। আগেরদিন দিল্লিতে লাটবাহাদুরের উপর বোমা ঝেড়ে সে রাতারাতি ফিরে এসেছিল দেরাদুনে তারপরে সভায় বোমা হামলার প্রতিবাদ করে ভাষণ দেয়। সেই ধরিবাজটা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে টিকটিকির কাজ করে ভুলভাল খবর দিয়ে পুরো দেড়-বছর আমাকে বাঁদর নাচ নাচিয়েছে। বড়লাট দেরাদুনে এলেন। কঠোর নিরাপত্তা। আমিও ওনার ঘরে ঢুকতে পারিনি। অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি ঘড়িয়ালটা বড়লাটের ঘরে অনায়াসে ঢুকছে, ব্রিটিশ পুলিশ বিভাগে এতটাই নেকনজরে ছিল সে। আর কি শেয়ানা দেখুন, যে মূহুর্তে জানতে পারলাম যে এই রাসবিহারী বসুই আসল লোক, অমনি সে পালিয়ে চলে গেল চন্দননগরের ফটকগোড়ার বাড়িতে। আমরা কেমন করে আন্দাজ করতে পারবো যে ছেলেটি এতদিন দাবড়ে বেড়াচ্ছিল, সে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে থাকবে! তারপর যখন জানতে পারলাম ফরাসী অনুমতি নিয়ে চন্দননগরে ধরতে গেলুম, সাথে মিস্টার ডেনহ্যাম ও চার্লস টেগার্ট। একসঙ্গে তিনটে বাড়িতে রেড করলাম। তোষক-বালিশের তুলো পর্যন্ত বার করে ফেললাম, তবু রাসবিহারীর টিকিটি পর্যন্ত পেলাম না। ফিরে আসার অনেক পরে খবর পেয়েছিলাম, সেদিন নিজের বাড়িতেই আম গাছের মগডালে পুরো একদিন কাটিয়েছিল সে। আরো অদ্ভুত, এই ঘটনার পরেও আরো একমাস সে চন্দননগরেই ছিল, সাধু ব্রাহ্মণের বেশে, আর আমরা অন্য সব জায়গায়ে দৌড়েছি।
একবার বিঙালীটোলায় কাশীতে। নিশ্চিত খবর, সমস্থ মহল্লটা আমরা ঘিরে ফেললাম। তবু ব্যাটা পালিয়ে গেল হিন্দুস্থানীদের মড়া সেজে। খাটিয়ায় নয়, মাদুর দিয়ে জড়ানো আর শুয়োরের মত একটা মাত্র বাঁশ থেকে ঝোলান। আমার আবার বদ অভ্যাস মড়া দেখলেই হাত তুলে নমস্কার করি। ব্যাটা নাকের উপর দিয়ে ড্যাং-ডেঙিয়ে বেরিয়ে গেল।
আর একবার.. সেটা আরও কেলেচ্ছা। সেটা অমৃতসরে। এবার মহল্লা নয়, একটা মাত্র বাড়ি। ইনফরর্মারের নিশ্চিত খবর। মাঝরাতে পুরো বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছি। সেবার ব্যাটা মেথর সেজে পালালো। বিশিষ্ট কায়স্থ বংশের ভদ্রলোকের ছেলে তুই! প্রায় উলঙ্গ হয়ে সাতজনের 'ইয়ে' ভর্তি মাটির হাড়ি মাথায় করে বের হয়ে পালালি! লজ্জা ঘৃণা ভয় - কিছুই নেই গা! সর্বাঙ্গে 'ইয়ে' লেগে রয়েছে। পুলিশ দেখে আবার হাত তুলে সেলাম করেছে। চারিদিকে দুর্গন্ধে ম-ম করছে। তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলে ব্যাটাকে দিলুম ধমক। একগাল সাদা দাঁত বার করে হাসলে মিশ কালো মেথরটা। আমি আজও ভাবি ব্যাটা গায়ে কি মেখেছিল .. রাসবিহারী দিব্যি ফর্সা অথচ জমাদারটা ছিল হাকুচ কালো!
মি লর্ড.. সত্যি বলতে কি ভারতের জনসমাজে বদ্ধমূল ধারণা আছে যে লোকটি মহান, উদার, চরিত্রবান ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি খোলাখুলি বলছি, ভদ্রলোকের চরিত্রের দোষ ছিল। এক পরস্ত্রীর সাথে সতেরো দিন সে লাহোরে উপপতি হিসাবে কাটিয়েছে। শুধু তাই নয়.. রাত্রিবাস.. এক ঘরে শুতো ওরা। তা ছাড়া লখ্নৌয়ে এক বেশ্যাপল্লীতে তার বেশ কিছুদিন থাকার অকাট্য প্রমাণ আছে আমার কাছে। মি লর্ড .. তখন যদি সন্দেহ হত.. বাছাধনকে হাতে-নাতে ধরতুম। তাহলে আমার ডিমোশন নয়, প্রমোশন হত। পুলিশ কমিশনার হয়ে রিটায়ার করতাম। তবে মনে করবেন না যে শুধু আমাকেই এভাবে ধুলো দিয়েছিল। বড় বড় অনেকেই এই বহুরূপীকে চিনতে পারেনি। অনেককেই সে বাঁদর-নাচ নাচিয়েছে।
লর্ড হার্ডিঞ্জ তার আত্মজীবনী 'মাই ইণ্ডিয়ান ইয়ারস ১৯১০-১৯১৬' গ্রন্থে লিখেছে - 'দেরাদুনে আমি যখন স্টেশন থেকে বাঙলার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তার ধারে এক বাড়ির সামনে কয়েকজন ভারতীয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে লক্ষ্য করলাম। তাদের সেলাম ছিল আভূমিনত। খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম ঐ সেলামকারীদের মুখপাত্র ছোকরাটি দুদিন আগে দেরাদুনে একটা জনসভায় আমার প্রতি বোমাবর্ষণের তীব্র নিন্দা করেছে এবং এ-বিষয়ে সভায় একটি প্রস্তাবও পাস করিয়ে নিয়েছে। দীর্ঘদিন পরে প্রমাণিত হয়েছিল ঐ ছেলেটিই আমাকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিল।'
মহাবিপ্লবীর একটা 'কোড অফ এথিকস' ছিল - প্রত্যেকে প্রত্যেকের পরিচয় জানবে না।
তবে এখানে দুটো খবর দি, এক- আমরা অনেকেই জানিনা যে কাশীতে থাকাকালীন রাসবিহারী বসু 'রুকমিনী' নামে এক পাঞ্জাবী মহিলার ছদ্মবেশও ধরেছিলেন। এবং দুই- রাসবিহারী বসু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে সামনে রেখে একটি জাতীয় পতাকার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তেরঙ্গা ঝান্ডা। শিখ, হিন্দু ও মুসলমান জাতীর প্রতীক হিসাবে হলুদ, লাল ও নীল। যে পতাকাটি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন যমুনা বাঈ (বিপ্লবী রামস্বরূপ শুকুলের স্ত্রী)। এই যমুনা বাঈ-এর সাথেই স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে টানা সতেরো দিন আত্মপরিচয় লুকিয়ে ছিলেন রাসবিহারী বসু। পরে ইংরেজ পুলিশের দ্বারা ভয়ঙ্কর অত্যাচারিত হবার পরেও এই যমুনা বাঈ লখ্নৌয়ে পল্লির বাড়িতে রাসবিহারী বসুকে আশ্রয় দেন আর যমুনা বাঈ-এর উদ্ধার ও আশ্রয় কর্তা ফকির সাহেব নিজের দাড়ি-গোঁফ কেটে তা আঠা দিয়ে রাসবিহারীর গালে বসিয়ে দিয়ে নিজে রাসবিহারীর কোট-প্যান্ট পরে বেড়িয়ে গেছিলেন। মহাবিপ্লবী ফকির রূপে ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়েছিলেন।
পরিকল্পনার সমস্তটা বুঝতে না পেরে যে ঘটনাগুলিকেই তার জবানবন্দিতে কুৎসিত ইঙ্গিত করেছিল ইংরেজ পুলিশের পা চাটা সুনীল ঘোষ। এই সুনীল ঘোষ ১৯৪৭-এর পরেও আরো তিরিশ বছর বেঁচে ছিল, আর নেহেরু-প্যাটেল সরকারের ঠিক করে দেওয়া পেনশন সে নিয়ে গেছে, ভোগ করেছে আর ভারতে মহাবিপ্লবীর চিতাভস্ম ফিরিয়ে আনার বিরোধীতা করে সংবাদপত্রে প্রতিবাদ পত্র লিখেছে। অথচ সেদিন ধরা পরার পরে যমুনা বাঈ-এর উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছিল রাসবিহারী বসুর খবর জানতে। না.. মা যমুনা বাঈ কোনও খবর দেননি, তাই ব্রিটিশ সেনা শিবিরে পরপর আটজনের ভয়ানক অত্যাচার সহ্য করার পর তিনি জ্ঞান হারান, তাঁর মনে নেই তারপরে আর কতজন তাঁর উপর অত্যাচার করেছিল। সেসময়ে ভারতবর্ষের জনজীবনে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ভক্তি-শ্রদ্ধায় কোন আসনে বিরাজ করেছিলেন, তা মা যমুনা বাঈ-এর সর্বস্ব দিয়ে এই মরণপণ সংগ্রাম এবং ধর্মের উর্ধ্বে উঠে এক ফকিরের ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
মহাবিপ্লবীর জীবন ভারতে থাকাকালীন একটা সময়ের পরে রহস্যে মোড়া। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের 'মাস্টারমাইন্ড'। তিনি না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন পথে যেত এবং কবে ভারতের স্বাধীনতা আসত তা বলা মুশকিল। হাজার চেষ্টাতেও ইংরেজ পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি। বার বার বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধরে তিনি ইংরেজ পুলিশকে বোকা বানাতেন। তিনিই প্রথম অন্যের নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন। মূলত তাঁর আহ্বানে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে এসেছিলেন। তিনি নেতাজীর হাতেই সমর্পণ করেছেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। সরকার গঠনেও ছিল তাঁর বিশেষ অবদান। নেতাজী গঠিত 'স্বাধীন ভারত সরকার'-এ তিনি ছিলেন সম্মানিত উপদেষ্টা - তিনি ভারতের মহাবিপ্লবী, জাপানিদের মনে বিখ্যাত "ইনদো শিশি" (ভারতীয় বীরপুরুষ) - তিনি রাসবিহারী বসু (মে ২৫, ১৮৮৬ - জানুয়ারি ২১, ১৯৪৫)।
- হে মহাবিপ্লবী বীর দেশপ্রেমিক শুভ জন্মদিনে তোমার চরণে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা, জানাই হাজার কোটি প্রণাম ও অনেক অনেক ভালবাসা।
জয় হিন্দ্
তথ্যসূত্র:@আমি রাসবিহারীকে দেখেছি: নারায়ণ সান্যাল।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন