![]() |
Hiroshima Day: August 6, 2021, will mark the 76th anniversary of the 1945 World War II atomic bombing. (Photo via National Archives) |
১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট সকালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর ৯ই আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নির্দেশে হিরোশিমায় স্থানীয় সময় আটটা পনেরো মিনিটে ফেলা হয় পরমাণু বোমা। লিটল বয় নামের সেই ভয়ংকর বোমার তান্ডবে নিহত হয় আশি হাজার মানুষ। হিরোশিমার তিনদিন পর নাগাসাকিতে ফ্যাটম্যান নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমায় মারা যায় চল্লিশ হাজার মানুষ। শুধু তাই নয়, পরিবেশের ওপর ওই পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহ প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
অনুমান করা হয় যে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে অধিকাংশের ধারণা এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়, যার ফলে পূর্ব-পরিকল্পিত জাপান আক্রমণ (invasion) সংঘটিত হলে উভয় পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হত, তা আর বাস্তবে ঘটেনি। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে এই বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল, কেননা জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল।
(১) সাদাকো কাহিনি
মেয়েটির পুরো নাম সাসাকি সাদাকো। হিরোশিমায় যেদিন বোমা পড়লো তখন তার বয়স মাত্র দুই। এপিক পয়েন্ট থেকে সাদাকোদের বাড়ি ছিল দুই কিলোমিটার দুরে। সাদাকো ঘরে ছিল। বোমার ঝাপটায় সাদাকো-সহ ঘরের সবকিছু ছিটকে বেরিয়ে গেল। মা বাইরে ছিলেন, ভাবলেন মেয়ে শেষ। গিয়ে দেখেন সুস্থ স্বাভাবিক বিনা আঘাতে মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাকো স্বাভাবিক ভাবেই বড় হয়ে উঠছিল। ১৯৫৫ সালে ১২ বছর বয়সে সাদাকোর এক রোগ স্পষ্ট হয়ে উঠল। লিউকোমিয়া। এই রোগের নাম স্থানীয় নাম ছিল এটম-বোম-রোগ। একই রোগে অনেক শিশু মারা যাচ্ছিল। সাদাকো এই খবর জানতো।
একদিন সাদাকোর বন্ধু এসে এক অদ্ভুত কাহিনি শুনিয়ে গেল। বলল-
সুস্থ হতে চাও ?
তাহলে কাগজ দিয়ে ১ হাজার সারস পাখি বানাও
জাপানিরা বিশ্বাস করে, সারস পাখি ১০০ বছর বাঁচে। সাদাকো বাঁচতে চাইল। বন্ধুর কথা বিশ্বাস করে কাগজ দিয়ে এক এক করে সারস পাখি বানানো শুরু করলো। ৫শ সারস বানানোর পর সাদাকো সুস্থ অনুভব করলো। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাবার অনুমতি দিল। কিছুদিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। সারস পাখি বানানো শুরু করলো। ৬৪৪ টা পর্যন্ত বানিয়ে আর পারলো না।
তবে স্কুলের বন্ধুরা সাদাকোকে অমর করতে চাইলো। ১ হাজার সারসের বাকী সংখ্যাটা পূরণ করতে ৩৫৬টি সারস বানিয়ে বন্ধুরা সাদাকোর কবরে দিয়ে আসবে এটাই প্ল্যান। এই খবর দেশবিদেশে ছড়িয়ে গেলে বিশ্বের ৩ হাজার ১শ টি স্কুল তাদের ডাকে সারা দিল। মিলিয়নস অব সারস পাখি সাদাকোর কবরে স্থান পেল। ৩ বছরের মাথায় স্কুল ছাত্রদের উদ্যোগে ফান্ড তৈরি হলো। সেই ফান্ড দিয়ে তৈরি হল একটি মনুমেন্ট। Hiroshima Peace Park এর ভিতর, বোমা খানা যেখানে পড়েছিল, তার পাশেই। মনুমেন্টে লেখা শিশুদের স্লোগানটি হলো-
This is our cry, This is our prayer, Peace in the world".
মানুষ মরবেই। বোমার আঘাতে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর পেইন, ম্যানুয়েল কিলিং এর পেইন আর অজানা অচেনা রোগে ধুঁকে ধুঁকে মরার পেইন আলাদা। হিরোশিমা যাবার সুযোগ হলে লক্ষ লক্ষ কাগজের সারস পাখি দিয়ে ঢাকা সাদাকো মনুমেন্টটি দেখে আসতে পারেন। ঘটনাটি জানা থাকলে সাদাকোদের আর্তনাদ শুনতে পাবেন।
(২) কামিকাজে পাইলট
কামিকাজের শাব্দিক অর্থ হলো ঐশ্বরিক বাতাস। কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে ঐশ্বরিক কিছুই নেই। বলতে পারেন সুইসাইড বোম্বারস। জেনারেলরা অল্প দামি প্লেনে এক পিস বোমা আর এক পিস পাইলট ঢুকিয়ে দিয়ে “যাও পাখি বল তারে” সিগন্যাল দিয়ে দিতেন। পাইলট সাহেব আমেরিকার নৌবহর দেখিবা মাত্র প্লেনে সহ ডাইভ দিতেন। প্লেন শেষ, বোমা শেষ, পাইলট শেষ। জেনারেল সাহেব দাগ দিতেন, এক প্যাকেজ কঞ্জিউম্যাবল শেষ। নেক্সট।
পরিবার থেকে পাইলট গণ বিদায় নিচ্ছেন। সেই লগ্নগুলো ভিডিও করে রেখেছেন ৭০ বছর আগে।
আমাদের দেশে সিনেমা নাটকে এমন সিন থাকে। ছেলে বিদায় নিচ্ছে। বলছে “মা যাই”। মা শুধরিয়ে দিচ্ছেন, “না বাবা, বলতে হয়, মা আসি”।
জাপানে ও একই ধরণের গ্রিটিংস আছে। বলতে হয় “ইত্তে কিমাস” (গিয়ে আসি)। কিন্তু কামি কাজে-র ট্রিপ গুলো হলো ওয়ান ওয়ে ট্রিপ। সবাই জানে। তাই অতি হৃদয়বিদারক মনে হলেও এদের বলতে হতো- “ইকিমাস” (যাই)। তারপর এক গ্লাস ওয়াইন খেয়ে বিমানে উঠছে।
এদের মধ্যেই একজন পাইলট ছিল, নাম তার হাসেগাওয়া। তিনি মারাত্মক এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে গাইতে গাইতে প্লেনে উঠেছিলেন। মাথায় জাপানের পতাকার লাল সুর্যের মার্ক ওয়ালা সাদা কাপড়ের ফিতা। পতাকার লাল সূর্যের পাশে লাল অক্ষরে কী যেন লেখা।
হাসেগাওয়া বিয়ে করেছিলেন যুদ্ধে যাবার ৩ মাস আগে। বউ এর পেটে ৩ মাসের বাচ্চা। সাহস করে বিদায় দিতে আসতে পারেনি। প্লেনের ওঠার আগে পাইলট সাহেব নিজের আঙ্গুলে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে লিখলেন বউয়ের নাম। ৎসুনেকো। ৭০ বছর ধরে আর্কাইভ হয়ে থাকা ভিডিও থেকে এই দৃশ্য খুঁজে পেতেই টেলিভিশনের প্রযোজক সাহেব ৎসুনেকোর বাড়িতে গেলেন। ৩ মাসের সেই বাচ্চার বয়স আজ ৭০ বছর ৩ মাস। সে তার মার লেখা ডায়েরি দেখালেন। অপেক্ষা করা আর অপেক্ষা না করতে পারার কাহিনি।
এমনি করে মারা গেছেন ৩ হাজার ৮শ ৬০ জন পাইলট। যুদ্ধে জিতে গেলে এরা সবাই আজ বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা পেত। জানা যেত ৩ হাজার ৮শ ৬০টি ভিন্ন কাহিনী। (সংগৃহীত).
'হিবাকুশা'
মেয়েটা প্রতিদিন সন্ধ্যায় পার্কে অপেক্ষা করত তার প্রেমিকের জন্য। অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলেটি আসত দেখা করতে। কিন্তু দিনটা ছিল ৬ আগস্ট, ১৯৪৫। প্রথমবার ছেলেটি আসেনি। পরে আর কোনও দিনও আসেনি। সেদিন যে মেয়েটির বয়স ছিল ১৭, সে আজ ৯১ বছরের বৃদ্ধা। এই ৭৪ বছরে অনেকবার তাঁর মনে হয়েছে, ছেলেটি হয়তো আসবে। কিন্তু তা ঘটেনি। ছেলেটির মা-বাবাও স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলেকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। ছেলেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘লিটল বয়’। ইতিহাসবিদরা বইয়ের পাতায় তাই লিখেছেন। কিন্তু জাপানের হিরোশিমা শহরের মানুষেরাই একমাত্র জানেন এবং উপলব্ধি করেন যে, সেটা আর যাই হোক ‘লিটল’ ছিল না। চুয়াত্তরটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কত স্মৃতি মুছে গিয়ে নতুন করে কত স্মৃতির জন্মও নিয়েছে। কিন্তু কান পাতলে আজও ঐতিহাসিক কান্না শুনতে পান জাপানের মানুষ। একটা জ্বলজ্যান্ত শহর সেদিন কবরে পরিণত হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে ৮০ হাজার মানুষ মৃতদেহ হয়ে গিয়েছিল! সংখ্যাটা কয়েক দিনের মধ্যে দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল! সেই শহরও আজ নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। সময় হয়তো অনেকটাই ব্যথা হালকা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই কলঙ্কিত দিনের আতঙ্ক ঘোচেনি।
৯ আগস্ট। সন্ধ্যায় নাগাসাকি পিস পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। হোটেলের লবিতে একদল শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবকদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাচিকো ইয়াসুই। সামনের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আকি, ইচিরো, মিসা, তোশি এবং সেই সঙ্গে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল সাচিকোর। ডিমের গল্পটা দিয়েই শুরু হয়েছিল দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা।
‘আমার বয়স তখন ছ’বছর। অন্য চার ভাইবোন আকি, ইচিরো, মিসা আর তোশি। ছোট্ট তোশি প্রতিদিনই ডিম খেত। কিন্তু আমাদের মুরগিটা সেদিন ডিম পাড়েনি। মা আর তোশি মিলে অনেকক্ষণ ডিম খুঁজেছিল। পায়নি। আমরা কাদামাটি নিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই আকাশে বি-২৯ বিমানের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। পিকাডন! (জাপানি এই শব্দটি দিয়ে মূলত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণকেই বোঝানো হয়ে থাকে। ‘পিকা’ অর্থ ‘অতি উজ্জ্বল আলো’ এবং ‘ডন’ অর্থ ‘বিস্ফোরণ’) অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তোশি, আকি, ইচিরো— ওরা সবাই চলে গিয়েছে। চলে গিয়েছে মিসাও। আমার বাবা, আমার মা সবাই। আমিও প্রায় মরেই গিয়েছিলাম।’ এটুকু বলে থেমে গিয়েছিলেন সাচিকো। শেষে শুধু বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন তোমাদের সঙ্গে কোনওদিন না হয়।’
কারেন স্টেলসনের লেখা ‘সাচিকো, আ নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’।
এক হিবাকুশার গল্প (Hibakusha)
পারমাণবিক বোমা হামলার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকির যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের বলা হয় হিবাকুশা। তাঁরা কেউই হিবাকুশা হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই সুন্দর একটা জীবন কাটাতে। কিন্তু ‘ফ্যাট ম্যান’ ও ‘লিটল বয়’ নামে দুটি অভিশাপ তছনছ করে দিয়েছিল তাঁদের সাজানো সংসার, সাজানো স্বপ্ন সহ সবকিছুই। তেমনই একজন হিবাকুশা ছিলেন সাচিকো ইয়াসুই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল।
যুদ্ধের ফলে নাগাসাকিরও তখন জাপানের অন্য আর পাঁচটা শহরের মতো দুঃসহ অবস্থা। সাচিকোর মনে আছে, বিমান হামলার সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পরিবারকে নিয়ে তাঁর বাবা পাহাড়ের বুকে তৈরি গুহাগুলোর দিকে ছুটতেন। সাকামোতো সিমেট্রির কাছেই ছিল সেগুলো। ইচিরোর হাত ধরে সাচিকো ভেজা ঘাসের মধ্য দিয়ে ছুটতেন। তাঁর গলায় ঝোলানো ব্যাগে রাখা বিস্কুটগুলো বারবার বুকে এসে আঘাত করত। গুহার প্রবেশপথে এসে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে যেতেন সাচিকো। গিয়েই উবু হয়ে বসে পড়তেন। ভেজা খড়কুটো বিছানো মেঝের শীতল পরশ তাঁকে শিহরিত করে তুলত। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো গুহার উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যেত। আর গুহার ভিতরে সাচিকোর মাথার উপর তখন ভনভন করে উড়ত অজস্র মশা। কী ভয়ঙ্কর ছিল সেই দিনগুলো!
৮ আগস্ট, ১৯৪৫
সেই সকালটা আর পাঁচটা উষ্ণ, আর্দ্র গ্রীষ্মের দিনের মতোই ছিল। দরদর করে ঘামছিল মেয়েটি। জামাকাপড়ও ঘামে ভিজে একাকার। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাচিকো। তাপে ঝলসে যাচ্ছিলেন তিনি। একই অবস্থা সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো শিন্তো মঠ, নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ এবং পুরনো কর্পূর গাছগুলোর। উত্তপ্ত হচ্ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ চার্চ হিসেবে খ্যাত উরাকামি ক্যাথেড্রাল এবং ছোট্ট দেজিমা দ্বীপ। যেখানে একসময় পা দিয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা। যখন জাপানের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তখনও নাগাসাকির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল পাশ্চাত্য দুনিয়ার।
হাঁটতে হাঁটতে স্যানো মঠের কাছাকাছিই চলে এসেছিলেন সাচিকো। কর্পূর গাছগুলো আর একটু দূরেই। গাছগুলো প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। এই গাছগুলোর পিছনেই স্যানো মঠের বৃহদাকার, পাথুরে গেটটি। আধ্যাত্মিকতার চাদরে মোড়া এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাচিকো মনে মনে প্রার্থনা করেন, ‘আবার যেন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারি!’
গত এপ্রিলের কথা। চারদিকের পরিবেশ তখন চেরি ফুলের গন্ধে সুশোভিত। জাপানের স্কুলগুলোর নতুন শিক্ষাবর্ষ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। সাচিকোকে নিয়ে তাঁর বাবা জেনজা প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছিলেন। বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ‘স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলবে।’ কিন্তু বাবা আর সাচিকো যখন স্কুলে প্রবেশ করলেন, শিক্ষকদের চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ। মার্কিন বিমান হামলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিমান হামলার সাইরেনের জন্য সেদিন সকালেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সাচিকো শুধুমাত্র তাঁর নতুন শিক্ষকের সামনে মাথা নোয়াতে পেরেছিলেন। এরপরই প্রিন্সিপাল স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেন। সাচিকোর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির স্বপ্ন সেখানেই মিলিয়ে যায়। পড়াশোনা শেখার বদলে সে শিখেছিল আঙুল দিয়ে কান এবং চোখগুলো ঢেকে রাখতে। সেই সঙ্গে শিখেছিলেন বাইরে থাকাকালে ‘টেকি’ (শত্রুপক্ষের বিমান) শব্দটি শুনলে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ার বিদ্যা!
৯ আগস্ট, ১৯৪৫
সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছিল সাচিকোর। অসুস্থ এক বন্ধুর খোঁজ নিতে বাবা তাড়াতাড়িই বের হয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। মা রান্নাঘরে গমের বল বানাচ্ছিলেন। মাকে কেমন আতঙ্কিত লাগছিল। কিছুক্ষণ পর মা ডাক দিলেন, ‘বাচ্চারা, এস, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’ সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। হঠাৎ বিকট এক শব্দে মা মাথা তুলে চাইলেন। ‘বাচ্চারা, তাড়াতাড়ি’, এটুকু বলেই মা তোশিকে কোলে তুলে নিলেন। সাচিকো তাঁর হুডটা খুঁজতে দৌড় দিলেন। আকি মিসাকে তাঁর হুড খুঁজে দিল। সাচিকোর হাতটা ধরেছিলেন ইচিরো। থেমে থেমে বাজতে থাকল সাইরেন। সাচিকোর পরিবার আবারও ছুটেছিলেন সেই গুহাগুলোর দিকে। মাথা নিচু করে গুহার ভিতর ঢুকে স্যাঁতস্যাঁতে মাদুরের উপর বসে পড়েছিলেন সাচিকো।
সকাল ৮টা বেজে ৩০ মিনিট।
সাইরেন থেমে গেল।
পরিচিত আরেকটি সাইরেনের শব্দ সবাইকে বুঝিয়ে দিল, বিপদ কেটে গিয়েছে। গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন সবাই। তোশির হাত ধরে রেখেছিলেন মা। ফের মুরগির ডিম খুঁজতে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
কিন্তু পরিকল্পনা খানিকটা অন্যরকমই ছিল বি-২৯ বোমারু বিমান ‘বক্সকার’-র ককপিটে থাকা মেজর চার্লস সোয়েনির। প্লেনটিতে ছিল প্লুটোনিয়ামের তৈরি ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে একটি পারমাণবিক বোমা। যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল ২১ হাজার টন টিএনটির সমতুল। সোয়েনির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিল্পনগরী কোকুরা। যদি কোনও কারণে কোকুরার মিশন ব্যর্থ হয়, তাহলে তালিকায় পরের নামটি ছিল নাগাসাকি।
সকাল ৯টা বেজে ৪৫ মিনিট।
বক্সকারকে নিয়ে কোকুরা শহরের উপর দিয়ে নিরাপদেই উড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন সোয়েনি। কিন্তু হঠাৎই বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। শুরু হল ঘন মেঘের চলাচলও। সেই মেঘরাশি সোয়েনির চোখ আবছা করে দিল। সোয়েনি কোকুরার উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার চক্কর দিলেন। জাপানি অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানগুলো ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু করে দিয়েছে। সোয়েনি তৃতীয়বার চক্কর দিলেন। বিমানের ক্রু’রা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। সকালে উড়ানের সময় ফুয়েল পাম্পটা ঠিকমতো কাজ করছিল না, প্রয়োজনের তুলনায় কম তেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সময়ও ফুরিয়ে আসছিল বেশ দ্রুত। দ্রুততার সঙ্গে অবশিষ্ট জ্বালানি নিয়ে একটা হিসাব কষে ফেললেন সোয়েনি। তালিকায় থাকা পরবর্তী নগরী নাগাসাকিতে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি তখনও ছিল। সোয়েনি প্লেন ঘুরিয়ে নাগাসাকির পথ ধরলেন।
সকাল ১১টা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই বক্সকার নীচের দিকে নামতে শুরু করল। উপর থেকে নাগাসাকিকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নগরীটি ঢেকে রেখেছিল। বক্সকারের টার্গেট ছিল পোতাশ্রয়ে থাকা মিৎসুবিশি শিপইয়ার্ড। কিন্তু উপর থেকে সেটা তারা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ করেই একখণ্ড মেঘ সরে গেল। ফলে নাগাসাকির ঘনবসতিপূর্ণ উরাকামি উপত্যকা বক্সকারের ক্রুদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। টার্গেট থেকে মাত্র ১ মাইল দূরে। চিৎকার করে উঠলেন সোয়েনি, ‘খুঁজে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি’। সঙ্গে সঙ্গে নিশানা করে সুইচে চাপ।
নাগাসাকির উদ্দেশে ধেয়ে গেল ফ্যাট ম্যান।
সকাল ১১টা বেজে ১ মিনিট।
দশ বছর বয়সি মেয়েটি হঠাৎ করেই ভয়ে পাথরের মতো জমে গেল। ‘টেকি’ বলে চিৎকার করে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মাদুরের উপর উপুড় হয়ে গেলেন সাচিকো।
সকাল ১১টা ২ মিনিট।
অতি উজ্জ্বল আলো, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা নাগাসাকি। অদ্ভুত, চোখধাঁধানো এক আলো আকাশজুড়ে। লাল, নীল, সবুজ- হরেক রকমের রং। নাগাসাকির আকাশে, প্রায় ৩.২ কিলোমিটার উপরে, ধীরে ধীরে জমাট বাঁধল একটি পারমাণবিক মেঘ। দেখতে অনেকটা বৃহদাকার মাশরুমের মতো। খানিক বাদেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছাদের টাইলসগুলো পুড়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টগুলো গলে নুয়ে পড়ল। একসময় সেই মেঘ পুরো আকাশটাকেই ছেয়ে ফেলল। ধূসররঙা, মোটা কম্বলের মতো ঢেকে দিল সূর্যটাকে। নাগাসাকির বুকে ভরদুপুরে নেমে এল রাতের অন্ধকার।
সাচিকোকে কে যেন শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল। পরক্ষণেই আবার সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়েছিলেন তিনি। পাথরের টুকরো, ভাঙা টাইলস, গাছের ডাল-পাতা— সবকিছু তাঁর উপর একে একে পড়তে লাগল। ক্রমশ এগুলোর নীচে চাপা পড়তে লাগলেন তিনি। নাকে-মুখে ধুলোবালি ঢুকে গিয়েছিল তাঁর। বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ৯০০ মিটার দূরে মাটিতে পড়ে কাঁপছিলেন তিনি।
প্রবল হাওয়ায় বৈদ্যুতিক তারগুলো ছিড়ে গিয়েছিল। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল রাস্তায় থাকা গাড়িগুলো। কাঁচ ভেঙে গিয়েছিল জানালার। কব্জা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল অনেক দরজা। উল্টে পড়েছিল অনেক ঘরবাড়ি। ভাঙা কাঁচের টুকরাগুলো বাতাসে বুলেটের মতোই এদিক ওদিকে ছুটে যাচ্ছিল। নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল উরাকামি ক্যাথেড্রাল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্যানো মঠও। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কর্পূর গাছগুলো দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, কী ভয়াবহ ঝড়টাই না বয়ে গিয়েছে তাদের উপর দিয়ে।
এরপর তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে সাচিকোর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি, নিজের ভিতরে চেপে রাখা কষ্ট। এই সবকিছু নিয়েই সাচিকো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘুরঘুরে পোকার মতো সে পুষ্টিদ্রব্য সংগ্রহ করতেন বাবার দেওয়া জ্ঞানের শিকড় থেকে। হেলেন কেলারের সাহস থেকে। এবং ভালোবাসা, অহিংসা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক গান্ধীজি ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বিশ্বাস থেকে। ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের পর থেকে সাচিকো ইয়াসুই জাপান ছুটে বেড়িয়েছেন। গিয়েছেন কানাডা এবং আমেরিকাতে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন, বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার। সাচিকোর জীবনটা যেন ‘ওলিয়েন্ডার’-এর মতো।
আসলে পরমাণু হামলার পর জাপানের মাটিতে প্রথম ফুটেছিল ওলিয়েন্ডার (করবী ফুল)। যা ঢেকে দিয়েছিল গত শতাব্দীর কলঙ্ক! সাচিকো ছিলেন নাগাসাকির ওলিয়েন্ডার।
সেদিনের সেই ঘটনা কি শুধু জাপানকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল? কিছু মানুষ বলেন, সেই পারমাণবিক বিস্ফোরণ নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি টেনে এলেছিল। বাইরে থেকে দেখলে হয়তো তাই মনে হয়। কিন্তু সেই ঘটনা বিশ্বকে অন্য এক যুদ্ধের দৌড়ে ঠেলে দিয়েছিল। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিষোগিতা!
চুয়াত্তর বছর আগে অগস্টের দু’টো দিন, ৬ আর ৯ তারিখ ভারতকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু তখন সেনাবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়েছেন ভারতে। অসমের পথ দিয়ে আইএনএ তখন এগোচ্ছে। এরপরই উত্তরবঙ্গের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারতেন পশ্চিমবঙ্গে। তারপর ইতিহাস তৈরি হত। কিন্তু ‘লিটল বয়’ সব শেষ করে দিল। জাপানকে বিধ্বস্ত করে দিল। নিজেদের দেশকে সামাল দিতে জাপানি সেনা ফিরে গেল। আইএনএ দুর্বল হয়ে পড়ল। ‘লিটল বয়’ সেদিন ভারতের ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল।
এ সব অবশ্য বিতর্কের বিষয়। কিন্তু যেটা ভাবায়, তা হল আচমকা একটি শহরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া! জ্বলজ্যান্ত গোটা শহর! চারদিকে কান্নার আওয়াজও ছিল না। কারণ, কান্নার জন্য জীবন্ত মানুষের থাকাটা দরকার। কেউই নেই তখন। মৃতদেহগুলো কতদিন পড়ে ছিল, কে জানে! সেই ছেলেটির দেহও হয়তো শুয়ে শুয়ে ভাবছিল মেয়েটির কথা। মাধরাস্তায় নির্ভয়েই শুয়ে ছিল সে! কারণ, আর কোন গাড়ি চাপা পড়ার ভয় নেই! তার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করছিল তাঁর প্রেমিকাও। চেয়ারে বসে। চেয়ারটার একদিক এখন ভেঙে পড়েছে। তবু মেয়েটি বসেই আছে। রাত্রিদিন, দুপুর-সন্ধ্যা, রৌদ্র-বৃষ্টি— কোনও কিছুই এই অপেক্ষার সামনে বড় হয়ে উঠতে পারল না! ঝলসে যাওয়া শরীরটা কেবল অপেক্ষা চেনে! কোনও একজনের বোন অন্য কোনও শহরে অপেক্ষায় ছিল। এই সপ্তাহে দাদা অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবে আর তাঁর জন্য উপহার নিয়ে আসবে। সেই অপেক্ষাটাও আর শেষ হয়নি। উপহার ছাড়াও যদি দাদা সেদিন ফিরে আসত, তা হলেও বাচ্চা বোনটা খুশি হত। কিন্তু দাদা আর কোনও দিন ফেরেনি। কত দাদার, কত বোনের মৃতদেহই বাড়ি ফেরেনি সেদিন!
হিরোশিমা আবার বেঁচে উঠেছে। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সময় ওই দুই শহরকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আজ এতগুলো বছর পর খুব কম প্রত্যক্ষদর্শীই বেঁচে আছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরাও আর কয়েক বছর পর থাকবেন না। শুধু স্মৃতিগুলো থেকে যাবে ভয়ঙ্কর স্মৃতির মতো! আতঙ্ক হয়ে! হিরোশিমা আর নাগাসাকির মৃত মানুষজনের স্মৃতিতে তৈরি স্মারকগুলো থেকে যাবে! না, তারাও সেই ধ্বংস দেখেনি। তারা তৈরি হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু ধ্বংসের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে তারা বেঁচে আছে আর বাঁচতে বলছে প্রতিনিয়ত। গোটা বিশ্বকে শান্তির বার্তা দিচ্ছে তারা। যুদ্ধের নয়, ধ্বংসের নয়, অবিমিশ্র শান্তির বার্তা। আর কোনও হিরোশিমা-নাগাসাকি না ডেকে আনার বার্তা।
(তথ্যসূত্র:
১- Sachiko: A Nagasaki Bomb Survivor's Story by Caren B. Stelson, Carolrhoda Books (২০১৬)।
২- বর্তমান পত্রিকা।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা।)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন